Home » জেলার ইতিহাস » ​ইটন্ডার ইতিকথা

​ইটন্ডার ইতিকথা

আমার কাছে পুজো মানে – প্রথম এক দুদিন রাত জেগে কোলকাতার ঠাকুর দেখা । তারপর

itanda10অষ্টমীর দিনটা এলেই কোলকাতার এই কোলাহল ছেড়ে পালিয়ে যাই  রাঙা মাটির দেশে – আমাদের দেশের বাড়ি । আমার পুজো মানে – পরিবারের সবাই মিলে সারাদিন জমিয়ে আড্ডা , হৈ-চৈ , গ্রামের সাবেকিয়ানা , ঠাকুরদালান আর বীরভূমের প্রাচীন ইতিহাসকে খুঁজে ফেরা ।  প্রতি বছরেই পুজো শেষে আমরা সদলবলে বেরিয়ে পরি – কখনও মালুটি , কখনও গড়-জঙ্গল আবার কখনও ঝারখন্ড লাগোয়া কোনো দুর্গম উষ্ণ প্রস্রবনের খোঁজে । এবছর নেট ঘেঁটে ঠিক করলাম ইটন্ডা যাবো – বোলপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বীরভূম জেলার সীমানায় এক প্রত্যন্ত গ্রাম । ইটন্ডা নামটা আসলে ব্রিটিশ ‘EAST INDIA’র অপভ্রংস । দেড়শো দুশো বছর আগে  অজয় যখন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত তখন – নীল চাষের আর ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল জায়গাটা । এখন অবশ্য সময়ের সরনি বেয়ে নদী সরে এসেছে আনেকটা , নীল চাষের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে । উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিভিন্ন পেশার মোট ১৮ টা পাড়া নিয়ে তৈরি এই বর্ধিষ্ণু গ্রাম – আজ কালের স্রোতে তার জৌলস হারিয়েছে ।
দেড়-দু ঘণ্টা বাদে বাদে বোলপুর থেকে সিঙ্গির বাস ছাড়ে, সেই পথেই পরে গ্রামখানা । অজয়ের ঠিক ওপাশেই আরেকখানা সিঙ্গি আছে । বর্ধমান জেলার   বর্ধিষ্ণু গ্রাম । মধ্যযুগীও কবি কাশীরাম দাশের জন্মস্থান ।
itanda1
৮ টা নাগাদ বাস স্ট্যান্ডে এসে শুনলাম -”আজ সকালের বাস আর আসেনি ভাই ! মাঝ রাস্তায় ইঞ্জিন বিগড়েছে । ”
পরের বাসে চেপে যখন গ্রামের সীমান্তে নামলাম তখন সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে । ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পায়েচলা সরু রাস্তা নেমে গেছে পিচ রাস্তা থেকে । দু-চার পা এগোতেই পুকুরপাড়ে একটা প্রকাণ্ড পাকুড় গাছ চোখে পরল যার কাণ্ডটা বড় আদ্ভুত ! ফাঁপা মনে হল দূর থেকে । একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম কাণ্ডটা আসলে একটা শতাব্দী প্রাচীন মন্দির , কিন্তু গাছটা এমনভাবে পুরো স্থাপত্যটাকে গ্রাস করেছে যে কয়েকটা প্রাচীন ইটের অবশেষ ছাড়া আলাদা করে মন্দিরটাকে বোঝার কোনো উপায় নেই ।  আঙ্কোরভাটের ‘Ta Prohm’কে মনে করিয়ে দিল । বীরভূমের ল্যাটারাইট মাটি আবার খনিজের ভরপুর । জলটুকু পেলেই বট,আশ্বথ,পাকুড়ের মত গাছ মন্দির আঁকড়ে ধরে । মূল মন্দিরটা হয়তো চারচালা কিম্বা রেখা দেউল শৈলীর অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল  । কিন্তু এভাবে মূল গ্রামের বাইরে এক খানা মন্দির দেখে একটু অবাকই হলাম । সাধারনত এরকম ছোট মাপের মন্দির জোড়ায় বানানো হয়ে থাকে । পাথরের অভাবে হয়তো খুব উঁচু করা যায়না বলেই বাংলায় একসাথে অনেকগুলো মন্দির তৈরির প্রথা আছে ।
itanda3
স্থানীয় পুরোহিতের কাছ শুনলাম -পুরান কথিত সতীর কেশ এই মন্দিরে এসে পরায় এর নাম হয় কেশবাইচণ্ডীতলা । এখনও একাদশীর দিন মেলা বসে প্রতিবছর । গর্ভগৃহে উঁকি মারতেই সিঁদুর মাখানো কালো মূর্তির টুকরো চোখে পড়ল। আসলে বাংলার জলবায়ুর জন্যই হোক কিম্বা পাথরের অভাবেই হোক , পোড়া মাটির ইট দিয়ে বাংলায় যে মন্দিরগুলো বানানো হয়ে থাকে তা খুব উঁচু করা যায় না যেমন , তেমনই খুব বেশীদিন টেকেও না । টেরাকোটার প্রলেপ দিয়ে কিছুটা ক্ষয় রোধ হয় ঠিকই , কিন্তু তার আয়ুও বড়জোর ৩০০-৪০০ বছর । পুরোহিতমশাই বললেন -ষোড়শ শতকে কালাপাহাড়ের আক্রমণে মন্দিরের প্রাচীন অস্টধাতুর বিগ্রহটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পরবর্তী কালে আবার অস্টাদশ শতকে বর্গী আক্রমনের সময়ে এই গ্রামের নদী – বন্দর প্রায় ধংস হয়ে যায় । গ্রামের বাকি মন্দিরগুলো সবই প্রায় ঊনবিংস শতাব্দীর শুরুতে বানানো । তবে দুঃখের ব্যাপারটা হল বছর কয়েক আগেই মন্দিরের বিগ্রহটা চুরি গেছে। সামনে যেটা চোখে পরছে সেটা মূল বিগ্রহটার আদলে বানানো নকল।
itanda
মনটা ভারি হয়ে রইল । গ্রামের সীমান্তে পাকুড় গাছের কোটরে গত ৩০০/৪০০ বছর ধরে অবহেলায় , আযত্নে পরেছিল অসাধারন  শিল্পকর্মটা । আজ হয়তো সেটা ইউরোপের কোনো বৈঠকখানায় কিম্বা কোনো ব্যক্তিগত  সংগ্রহশালায় পাচার হয়ে গেছে । এই তো দিন দুই আগে কোলকাতায় যখন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে থিমের ঠাকুর হল – সাধারন মানুষের ঢল নামল প্যান্ডেল গুলোতে । বহু জায়গাতে থিম হিসেবে তুলে ধরা হল প্রাচীন মন্দির শৈলী আর স্থাপত্য । মানুষ সারা রাত জেগে এই সব শিল্পকর্ম দেখলেন , প্রশংসা করলেন – অথচ পুজোর চারটে দিন বাদ দিয়ে বাকি দিনগুলোতে যদি বাংলার সাধারন মানুষের শিল্প , স্থাপত্য আর পুরাকীর্তিগুলোর প্রতি সামান্যও আগ্রহ থাকত – তাহলে হয়তো আমাদের অতীতটা এভাবে ধূসর হয়ে যেত না ।
itanda6
গ্রাম সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা দুপা হাটতেই ফুরিয়ে গেল । কাঁচা রাস্তা ধরে চলতে চলতে মোবাইলের নেট অন করতেই অবাক হলাম । দিব্বি নেট খুলছে ! কিন্তু আশ্চর্য ! ৫১ পীঠের মধ্যে কোথাও ইটন্ডার উল্লেখ পেলামনা । গ্রামীণ জনশ্রুতি লোকমুখে অনেকটাই বদলে যায় – শেষে তার থেকে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে বের করাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে অনেকসময়  । যে গ্রামের নামটাই এসেছে অস্টাদশ শতকের ব্রিটিশ কম্পানি থেকে – সেখানে ষোড়শ শতকে কালাপাহারের সময়ে কতদূর বসতি ছিল সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে (পরে ১৭৭৬ এ জেমস রেনেল সাহেবের বানানো ম্যাপে অজয়ের তীরে ইটিন্দা বলে একখানা ঘাঁটির উল্লেখ পাই ) । তবে কালাপাহাড়ের আক্রমন যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবে সবার প্রথমে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী পুকুরটায় জাল ফেলা দরকার ।  আশ্চর্যের ব্যাপারটা হল ,তুর্কি আক্রমনের জন্যই হোক কিম্বা কালাপাহাড়ের রোষেই হোক – বাংলায় ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী , এই তিনশো বছরের মধ্যে বানানো মন্দির প্রায় একটাও আর অবশিষ্ট নেই ! সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক সভ্যতার মধ্যে যেমন কয়েকশো বছরের আশ্চর্য নীরবতা , বাংলার ইতিহাসেও দ্বাদশ শতাব্দীর দেউল স্থাপত্য থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চালা স্থাপত্যে বিবর্তনের যোগসূত্রটা অন্ধকারেই রয়ে গেছে ।  এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই গ্রামের পথে হাঁটছিলাম । ডান দিকে একটা মোড় ঘুরতেই দ্বিতীয় মন্দিরটা চোখে এল ।
itanda7
পায়ে চলা সুঁড়ি পথ আর পুকুরের বাঁ পাশেই জোড় বাংলা মন্দির , তবে বিষ্ণুপুরের মত মধ্যেখানে চূড়া নেই । মন্দিরগাত্রে অসাধারন পোড়ামাটির কাজ তো ছেড়েই দিলাম , স্থাপত্যের বিচারে বা ইংরাজিতে আমরা যেটাকে ‘proportion’বলি – তার বিচারেও মন্দিরটা অসাধারন । অমিতাভ গুপ্তের ব্লগে পড়েছিলাম – বছর দশেক আগে  রাজ্য পুরাতত্ব বিভাগ আর INTACH এর যৌথ প্রচেষ্টায় মন্দিরটাকে ধংসের হাত থেকে বাঁচানো গেছে । ব্লগে মন্দিরটাকে হাড়কাটা কালীর মন্দির বলা থাকলেও স্থানীয় উচ্চারণে সেটা ‘হড়কা’ কালী মন্দির হয়ে গেছে । এর ইতিহাসটাও ভীষণ রোমাঞ্চকর । ব্লগের লেখা আর গল্পকথা মিশিয়ে যেটা বুঝলাম –
itanda8
প্রায় দুশো-আড়াইশো বছর আগে , গ্রামের এই দিকটায় দুর্ধর্ষ হাড়কাটা ডাকাতদলের আস্তানা ছিল , যারা  রীতিমত শব সাধনা করত  । সম্ভবত তারাই মন্দিরটা নির্মাণ করে ১৮৪৪ সালে । পরবর্তী কালে জালাল খান নামে এক পাঠান সেনাপতি , ডাকাত দলকে দমন করলে মন্দিরের মালিকানা আসে সিউরির এক ধনী পরিবারের হাতে ।  মাঝে কিছু পর্তুগিজও মন্দিরের সংস্কার করেছিল বলে জনশ্রুতি আছে । এরপর এক আদ্ভুত ঘটনা ঘটে ।  ব্রিটিশ আমলে মন্দির সংলগ্ন স্থান থেকে সন্ধ্যের পর এক কিশোরী নিখোঁজ হয় । সারা রাত খোঁজা খুঁজি করেও কিশোরীর সন্ধান মেলেনা । পরের দিন সকালে কিশোরীর রক্ত মাখা শাড়ির টুকরো মন্দিরের গর্ভগৃহে বিগ্রহের মুখে পাওয়া যায় । সেই থেকে বহুদিন , মন্দির সংলগ্ন জায়গাটা গ্রামবাসীরা এড়িয়েই চলতো । সময়ের সাথে বট – অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ি ইটের দেওয়াল ফাটিয়ে মন্দিরটাকে আরও জরাজীর্ণ করে তোলে । এখন অবশ্য INTACH এর সহযোগিতায় শুধু মন্দির সংস্কারই হয়নি – নতুন বিগ্রহ স্থাপন করে পুজোও চলছে পুরোদমে ।
itanda9
যতদূর জানি , বাংলায় নবজাগরণ আগে অস্টাদশ শতক পর্যন্ত গ্রামে গঞ্জে , শাক্ত কাপালিক , ডাকাত আর ঠগিদের মধ্যে তন্ত্র সাধনা আর বলিদান ব্যাপারটার চর্চা ছিল । আর তন্ত্র সাধনা বা শব সাধনার জন্য বেশ নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন । তাই কুসংস্কারাছন্ন গরিব গ্রামবাসীদের নরমাংস লোলুপ কালীর ভয় দেখিয়ে সেখানে নির্বিঘ্নে সাধনা চলতো । নারায়ন সান্যালের লেখা রুপমঞ্জারী উপন্যাসেও এরকম ঘটনার উল্লেখ পেয়েছি । ডাকাতরা সাধারনত কালীর ভয়ংকর দুটো রুপ- গুহ্যকালী বা শ্মশানকালীর সাধনা করত । ডাকাতি করতে যাবার আগে নরবলি দিয়ে কালীর পূজো হত । এখনকার নতুন বিগ্রহটা অবশ্য প্রচলিত দক্ষিণাকালীর রুপ। এই প্রসঙ্গে আমার একটা বিষয় মাঝে মাঝেই মনে হয় – সেটা হল স্থাপত্যের বিভিন্নতা বা স্থানভেদ অনুসারে বাংলার মন্দির স্থাপত্যকে চালা , রত্ন , দালান , মঞ্চ ,  চাঁদনি , দেউল ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । কিন্তু এই শ্রেণিবিভাগের সাথে কি পূজিত দেবতার কোনো সম্পর্ক আছে ? মানে কালী , বিষ্ণু বা শিব – দেবতার প্রকৃতি অনুসারে মন্দির স্থাপত্য কতটা ভিন্ন হত ! এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও গবেষণা দেখিনি !
itanda11
এক স্থানীয় গ্রামবাসীর সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম – সংস্কারের সময় যখন মন্দিরের দেওয়াল ফাটিয়ে গাছের শেকড় উপড়ানোর কাজ চলছিল তখন দেওয়ালের মধ্যে লুকোনো একটা মাটির হাড়ি পাওয়া যায় । মুখের সিলটা ভাঙা ছিল । যদি কিছু থেকে থাকে তবে আগেই সেসব লোপাট হয়ে গেছে । এছাড়াও মন্দির সংস্কারের সময় মন্দিরের মধ্যে যে গোপন সুরঙ্গ পাওয়া যায় ,রাজ্য পুরাতত্ব বিভাগ সেটাকে বছর দশেক আগেই বুজিয়ে দেয় । অন্ধকার সিঁড়ির ধাপ দিয়ে মাটির নীচে নামার সাহস হয়নি কারোর । আমার বিশ্বাস সুরঙ্গটা অজয় অব্দি গিয়েছিল । সে সময় নদীখাত মন্দিরের অনেক কাছে ছিল । তবে শেষ পঞ্চাশ বছরে গ্রামে বারকয়েক বন্যা হয়েছে । তাই সুরঙ্গপথ এতদিনে নিশ্চয়ই বুজে গেছে । এরকম সুরঙ্গ হুগলীর হংসেশ্বরী মন্দিরেও ছিল বলে শুনেছি । আগেকার দিনে জমিদার বা ভূস্বামীরা বাড়ির কাছে মন্দির তৈরি করলে , মাটির নীচে মন্দিরের গর্ভগৃহ পর্যন্ত সুরঙ্গপথ তৈরি করাতেন । তবে সুরঙ্গ বা ডাকাতদের তন্ত্র সাধনার কথা তো আগেও শুনেছি , কিন্তু এই মন্দিরকে যে পর্তুগিজরা সংস্কার করে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায় – এই বিষয়টাই আমাকে সবথেকে টানছিল । মন্দিরের ভেতর থামের গায়ে গ্রীক ‘Ionic Column’,মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ফলকে অসংখ্য ইউরোপিয়ান সেনা – এসবই প্রমান করে যে গ্রামে বিদেশীদের আনাগোনা ছিল । একটা টেরাকোটা ফলকে তো দুটো বোম্বেটে জাহাজকে রীতিমত যুদ্ধরত অবস্থায় দেখলাম । কালী মন্দিরের সাথে , পর্তুগিজদের সম্পর্ক অবশ্য এর আগেও শোনা গেছে । অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি কোলকাতায় এক কালী মন্দিরে প্রায়শই যেতেন । এখন সেটাকে আমরা ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি বলে জানি (যদিও এই যোগসূত্রটা নিয়ে বিতর্ক আছে । ) । ইতিহাসের পাতায় পড়েছিলাম , পর্তুগিজরাই বাংলায় প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে ১৫২৮ নাগাদ চট্টগ্রামে । হুগলীতেও ব্যবসা বানিজ্য চালাত । কিন্তু ১৬২৮ নাগাদ , পর্তুগিজ পাদ্রিরা বাংলায় ধর্মান্তকরন শুরু করলে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে বাংলার শাসক কাশিম খান পর্তুগিজদের নিধন শুরু করেন । প্রায় হাজার দশেক পর্তুগিজ , সম্রাটের রোষের বলি হয় । এর পরেও সপ্তগ্রাম , ব্যান্ডেল , ঢাকায় পর্তুগিজ প্রভাব ছিল । ১৬৬৬ নাগাদ চট্টগ্রামের যুদ্ধে শায়েস্তা খান পর্তুগিজদের আবার পরাজিত করে তাদের কফিনে শেষ পেরেকটা পুতে দেয় । বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন সেখানেই শেষ হয় তাদের । অবশ্য এরপরও যে কিছু পর্তুগিজ বাংলার মায়া কাটিয়ে যেতে পারেনি , তার উদাহরন তো এই গ্রামটাই ।
কাঁচা রাস্তা ধরে সামান্য এগোতেই মূল গ্রামটা শুরু হল । কয়েকটা ছোট্ট ছেলে ডাংগুলি খেলছিল রাস্তার ধারে । ওদের বাকি মন্দির গুলো কোথায় জিজ্ঞেস করতেই উঠে সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখালো ।
নদীটা কোথায় রে ?  জিজ্ঞেস করলাম । পাশের ধানক্ষেতটার দিকে  দেখিয়ে বললো মাঠ ধরে মিনিট পনেরো যেতে হবে । ওর বন্ধুর বাড়ির দুতলার ছাদ থেকে নাকি নদী দেখা যায় । এক দেড় কিলোমিটার হবে বড়জোর । নদীর ওপার থেকেই বর্ধমান শুরু ।
একটু এগোতেই দুটো বাড়ির মধ্যে দিয়ে একটা সরু গলি ; গলির শেষেই তৃতীয় মন্দিরটা । অবশ্য সামনের রাস্তা থেকেই মন্দিরটা দেখা যায় । বেশ উঁচু মন্দির । লোকজন না জানলে অবশ্য ,মন্দির না বলে পুরনো বাড়ি বলেই ভুল করবে । দুতলা ‘Flat Roof Structure’ ,বাংলার একতলা চাঁদনি মন্দিরগুলোর সাথে কিছুটা মিল থাকলেও এই স্থাপত্য রীতি বাংলায় বিরল । কিন্তু সামনের থাম গুলো দেখে অনভিজ্ঞ চোখেও ইউরোপিয়ান প্রভাব ধরা পরবে । আগেকার দিনে জমিদার বাড়িগুলো যে ‘Palladian Mansion’এর অনুকরনে বানানো হত , এই মন্দিরের সামনেও সেরকম থামের সারি । ‘Ionic Column’গুলোর উপরের গোল আংশটা ভেঙ্গে গিয়ে এখন বৃত্তাকার লোহার শিক গুলো বেরিয়ে এসেছে । রোদ , ঝড় , বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় চুন সুরকি খসে পরছে । গোল গোল ইট গুলোর মাঝে আগাছা বাসা বেঁধেছে । সবুজ শ্যাওলা মাখা মন্দিরের দালানটা অত্যন্ত পিছল । পা রাখতেই ঠাণ্ডা ভিজে স্যাত স্যাতে একটা আনুভুতি হল । মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালে কয়েকটা টেরাকোটার ফলক বসানো আছে । ঠিক তার উপরেই রঙিন ‘stucco’র কাজ । নীচে শিকল আটকানো দুটো বন্ধ ঘর । পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে । অবস্থা দেখে বুঝলাম যে বহু বছর তাতে মানুষের পা পরেনি ।
সময় সুযোগ পেলেই বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে মন্দির দেখা আমার নেশা । বহু জায়গায় গিয়েছি । কিন্তু বীরভূমের এক প্রতন্ত গ্রামে যে এত সুন্দর ভাবে বাংলার মন্দির স্থাপত্য আর ইউরোপিয়ান রীতি মিলে মিশে থাকতে পারে -সে ধারনা আমার ছিলনা । নেশাগ্রস্থের মত ক্যামেরার শাটার টিপছিলাম । এমনসময় কানে এল –
– ”এই ছেলে । নেমে এস এখুনি । জুতো পায়ে কেউ মন্দিরে ওঠে ? ” পাশেই মাটির বাড়ির দরজা ধরে এক মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । সুরসুর করে নেমে এলাম কথা না বাড়িয়ে । এরপর কথায় কথায় বেরিয়ে পরল আমাদের দেশের বাড়ি পুরন্দরপুর ।  শুনেই ভদ্রমহিলা চোখ বড় বড় করে বল্লেন – ”ও বাবা । আপনারা কুটুম যে ! আমার স্বামীও ওখানেই মানুষ । ঘরে আসুন দেখি । দুপুরের খাবারটাও খেয়ে যাবেন । ”
কি আদ্ভুত ব্যাপার । মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গৃহস্বামী হন্ত দন্ত হয়ে চলে এলেন বাইকে করে । আমাদের গ্রামের নাম শুনেই সে কি খাতির ! অনেক কাকুতি মিনতির পর শেষে রফা হল দুপুরের খাবার না খেলেও বিজয়ার মিষ্টিটুকু খেতেই হবে । তিনখানা স্টিলের প্লেটে অন্তত তিরিশ খানা নাড়ু এল বিভিন্ন ধরনের । সে কি ভয়ানক জোর জবরদস্তি ! সম্পূর্ণ অচেনা আজানা তিনটে মানুষকে এভাবে যে কেউ আপন করে নিতে পারে – এ আমরা শহরের লোকেরা কল্পনাও করতে পারবোনা ।  ঠুসে ঠুসে মিষ্টি খাইয়ে তবে তাদের শান্তি ।
 ”সাধু’ আমরা । এ মন্দির তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরই তৈরি ভাই । আগে নীল চাষের জন্য এগ্রামের নাম ছিল । এখন অবশ্য নীলকুঠি টা ভেঙ্গে সরকার ‘Flood Shelter’বানিয়ে দিয়েছে ।  রাস্তার ধারে , মাঠের আলে এখনও দু চারটে নীল গাছ হয় ।  যাইহোক আগে এখানেই দালান বাড়ি ছিল আমাদের । ব্যবসা করে টাকা করেছিল পূর্বপুরুষরা। ” সত্যিই তো ,ঘরের ভেতর মাটির দেওয়ালের মধ্যে থেকে দেখলাম বহু প্রাচীন চুন সুরকির দেওয়ালের একটা অংশ বেরিয়ে এসেছে । ‘এখন আমাদের আর সে অবস্থা নেই ভাই  । মাটির বাড়িতে থাকি । কোলকাতা থেকে মাঝে সাঝে লোকজন আসে । মন্দিরটা সারাবে বলে চলে যায় । আর কেউ ফেরেনা । আমাদের সে অবস্থাও নেই যা সারাবো । হয়তো সামনের বর্ষাতেই সামনের দিকটা পরে যাবে ।”
যথাসাধ্য চেষ্টা করব । আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এলাম । ‘কেউ ফেরেনা’ শব্দটা কানে বাজছিল । কিভাবে ওদের বলবো যে , কেউ ফিরবেওনা কাকা । প্রতিদিন এই বাংলায় কত প্রাচীন মন্দিরের ছাদ ধসে পরে , কত টেরাকোটার ভাস্কর্য সিমেন্টের প্রলেপের নীচে মুছে যায় – কেউ পরোয়াও করেনা ।  ভাঙ্গা চোরা কয়েকটা মন্দির ভেঙ্গে  কোথায় ফ্ল্যাট উঠে গেল , কোথায় কয়েকটা পোড়ামাটির পুতুল নষ্ট হয়ে গেল তা নিয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় বাঙালির সত্যিই নেই । এই নিয়ে আমাদের মত দু চারটে পাগল ছাড়া কেউ মাথা ঘামায় না ।
গ্রামের বাকি তিনটে মন্দিরও পাশেই । একটা পঞ্চরত্ন , একটা রেখা দেউলের ছোট সংস্করণ । আর মাঝেরটা খুব আদ্ভুত । ছোট্ট আয়তকার মন্দিরটা , সমতল ছাদ । একধারে একটা ছোট্ট দরজা । ভেতরে প্রাচীন শিব লিঙ্গ। পঞ্চরত্ন মন্দিরটার গায়ে কালো পাথরের উপর বাংলায় কিছু খোদাই করা ছিল । ভাই পড়ার চেষ্টা করছিল । আমি বিজ্ঞের মত বললাম – ” ও পড়তে পারবিনা । প্রাচীন বাংলা । চর্যাপদের মত ভাষা । ” কি আশ্চর্য । একটু মনযোগ দিতেই দেখলাম দিব্বি পড়া যায় ।
                                                        ”শ্রী শ্রী সিব মন্দীর । শকাব্দ ১৭৫০ সত্তে । রসত্ত পঞ্ছাসসন । ১২৩৫ সান প্রীরা । সানন্দ সাধুখাঃ ”
‘রসত্ত পঞ্ছাসসন’ টা সম্ভবত দিন বা তিথি জাতীয় কিছু হবে । ১৭৫০ শকাব্দ মানে ইংরাজিতে ১৮২৮ সাল ।  মন্দির প্রতিষ্ঠাতা হলেন – সানন্দ সাধুখাঃ । তবে সে সময়ের ‘সাধুখাঃ’ উপাধি যে কি করে আজ ‘সাধু’ হয়ে গেল কে জানে !
টেরাকোটার ছবি গুলো মন দিয়ে ক্যামেরাবন্দী করছিলাম । বাবা মনে করিয়ে দিল এবার ফিরতে হবে । ১২.৫০ এর বাসটা মিস করলে পরেরটা আবার সেই ৩ টে নাগাদ । আর এই গণ্ডগ্রাম থেকে অটো , টোটো – কিছু পাওয়াও যাবেনা ।  ক্যামেরা বন্ধ করে ফেরার রাস্তা ধরলাম । ছোট্ট গ্রাম । দু পা হাটতেই বাড়ি ঘর কমে এল । গ্রামের সীমান্তে সাদা রঙের একটা দুতলা পাকা বাড়ি । বাইরে থেকে খুবই সাধারন । সামনেই গ্রিল দেওয়া বারান্দা , সিমেন্টের পাকা দেওয়াল । কিন্তু ভেতরের দেওয়ালটার দিকে তাকাতেই চোখটা আটকে গেল । অন্তত দু ফুট চওড়া দেওয়ালটা । উপরের প্লাস্টার দু এক জায়গায় খসে , ভেতরের ইটগুলো বেরিয়ে পরেছে । আগেকার দিনের ছোট ছোট ইট । দুশো বছরের পুরনো হলেও আশ্চর্য হবনা । খুব ইচ্ছে করছিল ভেতরের লোকদের সাথে আলাপ করি ।
 আবার সেই একই পথ ধরে হাটতে হাটতে জোড়বাংলা মন্দিরটাকে পেরিয়ে , শতাব্দী প্রাচীন পাকুড় গাছটাকে পাশ কাটিয়ে যখন পিচ রাস্তায় পৌছালাম – দেখলাম রাস্তার ধারে চার পাঁচজন রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বাসটা ধরবে বলে । আনেকদিন বাদে টিনের স্যুটকেস দেখলাম একটা ছেলের হাতে । পাশেই একটা মেয়ে কোলে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বাচ্চাটার রোদ লাগছিল ,তাই মেয়েটি হাতে আঁচল নিয়ে ঢেকে রেখেছে মুখখানা । সম্ভবত স্বামী স্ত্রীই হবে । ছেলেটার বয়স বড়জোর কুড়ি বাইশ । গায়ে সিল্কের সবুজ জামা ,পায়ে একটা টকটকে লাল জুতো । বেশ উগ্র সাজপোশাক । ওদের দিকে তাকিয়েই দিব্বি সময় কাটছিল , এমন সময় দূর থেকে হর্ন বাজাতে বাজাতে বাসটা এল । ফাকা বাস । জানলার ধারেই বসার জায়গা পেলাম । দু ধারে দিগন্ত বিসারী সবুজ ধানক্ষেত । হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল । একটু বাদেই একটা ছোট খাল পেরোলো বাসটা । পাশের লোকটা বল্লো এটাই আগে আজয়ের মূল ধারা ছিল । এখন কোলকাতার আদিগঙ্গার মত অবস্থা । ছোবড়ার গদিতে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম । আর হয়তো কোনদিনও এই পথে আসবোনা । সবার অলক্ষ্যেই রোদে , ঝড়ে , বৃষ্টিতে মন্দিরগুলো নষ্ট হয়ে যাবে একটু একটু করে । ব্যক্তিগত ভাবে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা , কিন্তু মানুষকে করি । প্রতিটা মন্দির , প্রতিটা টেরাকোটা ফলক আমাদের এই সভ্যতার , এই বাংলাদেশের সংস্কৃতির , আমাদের ইতিহাসের , আমাদের সমাজচিত্রের জীবন্ত দলিল। এগুলোকে যখন নষ্ট হতে দেখি তখন মনে হয় শুধু কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্যই নষ্ট হলনা , হারিয়ে গেল আমাদের গর্ব ,আমাদের বাঙ্গালিয়ানা , স্বকীয়তা , আর ইতিহাস ।
বোলপুর আসার আগেই ভাইয়ের ধাক্কায় ঘুম ভাঙল । ”দাদা , আমাদের কি কিছুই করার নেই । ” আমি ঘুম চোখে মাথা নাড়লাম । ”ASIকে জানালে কিছু হবেনা ? নিলয় জেঠুতো আছেন ।” আমি হেসে আবার চোখ বুঝলাম । মনে মনে ভাবছিলাম ,  কিছু করার ক্ষমতা হয়তো নেই । কিন্তু আর কিছু নাই পারি , অন্তত লিখে আর দশটা মানুষকে জানাতে তো পারি । সেটাই বা কম কি ।  সেই চেষ্টাই করবো নিজের মত করে    ।
……………………………………………………………………………  ইটন্ডার ইতিকথা (অরুনাভ সান্যাল )
 Courtesy – Wikimapia , James Rennell…কৃতজ্ঞতা স্বীকার – অভিজিত সান্যাল ও অনুব্রত সান্যাল
Download করুন Pdf – এ:- Itonda Writing Arunava
arunava

Comments