Home » গল্প ও প্রবন্ধ » মিউটেশন

মিউটেশন

বাপ্পাদিত্য পালআর সহ্য হলোনা অনীশের! বাইকটাতে এক লাথি মারল তল পা দিয়ে। চারিদিকে সমস্যা। রায়পুরে তার অফিস থেকে ফিরছিল। অফিস বলতে স্টেটব্যাঙ্ক। সেখানে সে ক্লার্ক! নতুন চাকরি, দু মাস হল জয়েন করেছে, কিন্তু এর মধ্যেই ঝামেলা বেধে বসে আছে। একটা অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ট্রান্সফার নিয়ে। । ম্যানেজার অনেক খিটখিট করছে সেইটা নিয়ে। তাই নিয়ে দুদিন ধরে টেনশন । ওদিকে বাড়িতে আবার বাবার হাঁপানি টা বেড়েছে, মা বলেছে বাড়ি ফিরতে। বাড়িতে মা একা। কিন্তু অফিসের একটা হিল্লে না হওয়া অব্দি যাওয়াও যাচ্ছেনা। সে নিয়েও এক অস্বস্তি। গত সাত দিন ধরে ল্যাপটপ টা খারাপ হয়ে আছে, দোকানে সারাতে দিয়েছে। আজ সন্ধ্যা সাত টা নাগাদ দেওয়ার কথা আছে। আবার আকাশে কালো মেঘ ও উঠছে ফনা তুলে। ভ্যাপ্সা গরম, বৃষ্টি ও আসবে হয়ত।  বৃষ্টি ইদানিং অসহ্য লাগে অনীশের। মনে হয় সব প্ল্যান-পরিকল্পনায় কেউ যেন “জল ঢেলে” দিচ্ছে।একটু তাড়াহুড়ো করেই তাই বাইক চালিয়ে কাশিপুর ফিরছিল সে। কাশিপুর একটা শহর। রায়পুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে। সেখানে জীবন্তি মোড়ের কাছাকাছি একটা বাড়িতে সে ভাড়া থাকে। মাঝ রাস্তায় গেল বাইক টা পাংচার হয়ে। অজ পাড়া গাঁ এই রায়পুর। কাছাকাছি গ্যারেজ তো দুরের কথা, একটা চা এর দোকানও নেই। রাস্তারও সেই অবস্থা। পিচের চামরা মাংস উঠে পাথুরে কঙ্কাল বেড়িয়ে আছে যেন। কি মরতে স্টেটব্যাঙ্ক এখানে শাখা খুলে বসে আছে কে জানে। এখন কাছাকাছি বাজার বলতে এই হার জিরজিরে রাস্তা টা যেখানে হাইরোডে মিশছে সেই চারমাথা মোড়, সে প্রায় তিন কিলোমিটার এখনও। সেখানে গ্যারেজ আছে হয়ত। উপায়ন্তর না দেখে অনীশ বাইক টা ঠেলতে শুরু করলো।  ঘেমে নেয়ে যখন হাইরোড মোড়ে পৌছাল তখন প্রায় রাত ৮টা। দু একজনকে জিগেস করে গ্যারেজ এর হদিশ পেল। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গ্যারেজ টায় গেল সে। কিন্তু গ্যারেজ এর ছেলেটা বলল “দাদা আজ আর হবেনা। দোকান বন্ধ করব” সেরেছে রে! মনে মনে বলল অনীশ। মুখে বলল-“ভাই আমায় বাড়ি ফিরতে হবে, কাশিপুর, বাইক ঠিক না করে দিলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে” –“সে আমি জানিনা, আজ হাত পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছি, আর কালি মাখব না” –“ভাই একটু বেশি টাকা নিয়ে নিও না হয়” –“না দাদা পারব না বললাম তো” রাগ হল অনীশের , কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে এখন। ভাবল অন্তত বাইকটা যদি এখানে রেখে যাওয়া যায়, তাহলে সে বাস ধরে কাশিপুর ফিরতে পারে। বলল ‘ভাই তাহলে বাইক টা তোমার গ্যারেজে রেখে দাও আপাতত…কাল সারিয়ে রেখ, আমি এসে নিয়ে যাব” –“রাত্রে গাড়ি রাখতে দুশো টাকা লাগবে”।
দু’শো!! তাও ভাল, অন্তত রাখা তো যাবে। অনীশ বলল “আচ্ছা ঠিক আছে। তা নিও দুশো টাকা”। ছেলেটা গাড়ি স্ট্যান্ড করার জায়গা টা দেখিয়ে দিল। সেখানে বাইকটা রেখে রেনকোটের প্যাকেট টা বের করে নিল টুলবক্স থেকে। দিয়ে এসে দাঁড়াল হাইওয়ের ওপর। খিদে, ক্লান্তিতে যাচ্ছেতাই অবস্থা। পাশে একটা পান বিড়ির দোকান আছে। অনীশ সেখানে গিয়ে দোকানদার কে জিগেস করলো “দাদা কাশিপুর যাওয়ার বাস কখন আছে জানেন?” লোকটা খামখা যেন রেগে গেল। “জানিনা” বলে অন্য দিকে তাকাতে শুরু করলো। কি মুস্কিল! আজ কিছুই মসৃণ ভাবে হচ্ছে না। একে সময় ঠিক যাচ্ছে না, তার উপর মানুষ জনও কিরম ব্যবহার করছে তার সাথে। দোকান থেকে সরে এসে একটা তুলনামুলক ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল সে। একটু অপেক্ষা করতেই একটা বাস এল, কাশিপুর হয়ে যাবে। বাসে চাপল অনীশ, সিট ফাঁকা নেই! এখন দাড়িয়ে থাক এক ঘণ্টা, ক্লান্ত পা নিয়ে! দরজার কাছটাতেই দাঁড়াল সে।  বাস ও চলছে মন্থর গতিতে। জোর করে বিয়ে দেওয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাওয়া যেন…ইচ্ছা নেই।পাড়ার হোটেল টাও হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে পৌছাতে পৌছাতে।  যা হছে হোক। দাড়িয়ে রইল অনীশ। পরের স্টপেজে এক ভদ্রমহিলা নেমে গেলেন। কিন্তু যে সিটটা ফাঁকা হল সেটা লেডিজ সিট।দুজন বসার। আর একজন যুবতী বসে আছেন সেখানে তখনও।এমনিতে বাসে অনীশ লেডিজ সিট ফাঁকা থাকলেও বসে না, দাড়িয়ে থাকে, অস্বস্তি লাগে তার বসতে। কিন্তু আজ একটু বসতে পারলে মন্দ হত না! মনে মনে ভাবছিল সে। তখনই সেই মেয়েটি বলল ‘আপনি চাইলে বসতে পারেন এখানে’ -‘আমাকে বলছেন?’ -“হ্যাঁ, আর তো কেউ দাড়িয়ে নেই কাছাকাছি’ একটু থতমত খেল অনীশ। -“না মানে ঠিক আছে, আমি দাড়িয়ে ঠিক আছি, ধন্যবাদ।” ভদ্রমহিলা “আচ্ছা” বলে আবার জানালার বাইরে তাকাতে শুরু করলেন। অনীশ কিন্তু মনে মনে একটু খুশি হল।অনেকক্ষণ পর কেউ এভাবে বলল। ভ্যাপসা বিরক্তিতে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া। অনীশ এবার ভদ্রমহিলার দিকে ভাল করে চাইল। উনি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকার বাইরে টা। কি দেখছেন কে জানে। প্রচলিত অর্থে খুব সুন্দরি হয়ত নন। তবে চেহারায় অসম্ভব কমনিয়তা আছে। দেখলে চঞ্চলতা থিতিয়ে পরে একটা অকারন হাল্কা হাসির তলে। পাশে বসলে হয়! আর একবার যদি “চাইলে বসতে পারেন” এটা বলেন তাহলেই অনীশ বসে পরবে। কিন্তু উনিতো আবার জানালার বাইরে তাকাতেই ব্যস্ত। কিছু কথা বললে হয়। তাহলে ফের বসার কথাটা আসতে পারে। কিন্তু কি বলবে? উটকো কিছু বললে ভদ্রমহিলা আবার যদি……যাকগে, এমনিতেই মেজাজ খারাপ। কিন্তু মনটা উসখুস করতেই থাকল! একটু পর ঘাড়টা একটু সিটের দিকে ঝুকিয়ে অনীশ জিগেস করেই বসল ভদ্রমহিলা কে- “আচ্ছা বাসটা কি জীবন্তি মোড় হয়ে যায়? আপনি জানেন?”  ভদ্রমহিলা তাকালেন অনীশ এর দিকে। -“না। এটা তো কাশিনগরের ভেতর দিয়ে যায় না।“ -“ওহ” -“আপনি জীবন্তি যাবেন?” -“হ্যাঁ”  -“তাহলে আপনাকে হাইরোডের উপর কালিতলা মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে রিকশা টিকশা করতে হবে জীবন্তি অব্দি ” -“আচ্ছা” -‘সে দূর আছে তো। আপনি বরং বসেই যান। …ভয় নেই, এটা মাতৃভূমি লোকাল নয় তো’ ভদ্রমহিলা বললেন। হেসে ফেলল অনীশ। এত বিরক্তি ছিল একটু আগে…যেন বেমালুম উধাও হয়ে গেছে সব। ভদ্রমহিলার পাশে বসতে বসতে বলল “না। সে ভয় এমনিতেই নেই। বাস যা চলছে! কোন ফেমিনিস্ত ছুঁড়ে দিলেও মাটিতে পড়ার আগেই আবার বাসে উঠে পরব” –“হা হা”। এবার হাসলেন ভদ্রমহিলা। “যা বলেছেন। দোষ অবশ্য বাসের না। রাস্তার”  -‘হ্যাঁ। রাস্তাও খারাপ। আপনি কোথায় যাবেন?’- ভদ্রমহিলা কে জিগেস করলো অনীশ। -‘নগর’ -‘আচ্ছা. সেটা কতদুর?’ -‘কাশিপুরের পরেই তো। কাশিপুরে থাকেন, নগর চেনেন না? সেকি’ -‘না…আসলে এখানে নতুন তো।দুমাস হল সবে” –“ও আচ্ছা। ‘ভিনদেশী তারা’  ‘তারা’ না হলেও ‘তাড়া’ তো বটেই। রোজকারের তাড়া। তাই নদীয়া ছেড়ে এত দূরে এক অজ গ্রামের একটা ব্যাঙ্কে টাকা আর আকাউন্ট নিয়ে লোফালুফি করতে আসা। মনে মনে ভাবল অনীশ। মুখে কিছু বলল না। হাসল শুধু। ভদ্রমহিলা আবার জিগেস করলেন “এখানে কি করছেন তাহলে?” -‘এদিকে রায়পুর বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানে স্টেটব্যাঙ্ক এ চাকরি করি।” -“আচ্ছা। আর জীবন্তি তে?” -“সেখানে একটা বাড়িতে ভাড়া আছি’ -“বেশ।ভালো!” -“ভাল? কি ব্যাপারে?” -“মানে এখন চাকরির যা অবস্থা। কাশ্মীরি আলুর দমে কাশ্মীর খুজে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ খুজেও চাকরি পবেন না। সেই যায়গায় ব্যাঙ্কের চাকরি…ভালই। তাই বলছি”।  “হমম!তা ঠিক”! আবার হাসল অনীশ। বেশ গুছিয়ে কথা বলেন ভদ্রমহিলা। “কতদিন হল চাকরি পাওয়া?” ভদ্রমহিলা জিগেস করলেন।  “এইত দুমাস। বি.এস.সি, এম.এস.সি পড়লাম। তারপর দায়ে পরলাম। দিয়ে ব্যাঙ্কের চাকরি” -“হা হা…দায়? না না সেরম না।পার্মানেন্ট চাকরি তো। ঠিকই আছে না!”
প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না অনীশ। কিছুক্ষণ চুপচাপ আবার। বাস চলছে। মাঝে কন্ডাক্টর এসে ভাড়া নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা আবার জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। অনীশ ও তাকাল বাইরের দিকে। অন্ধকার পুরো। ওনার দু একটা চুল উড়ে এসে মাঝে মধ্যে অনীশের গলাতে, গালে পড়ছে। বাইরের অন্ধকার যেন ওই কালো চুল বেয়ে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার বেশ ভালোই লাগছে অনীশের। একটু আগের বিরক্তিটা বহুযুগ আগের মনে হচ্ছে। দূরে গ্রামে কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। কালো অন্ধকারের গায়ে ক্ষতর মত যেন।  অনীশের মন হল জিগেস করতে যে উনি কি করেন। কিন্তু যদি কিছু না করেন! ব্যাপারটা ঠিক হবে কি…কিন্তু কথা টা চালিয়ে যেতে ভাল লাগছে। একটু নিচু গলায় জিগেস করলো অনীশ “আর আপনি কি করেন? মানে কর্মজীবনে” ফিরে চাইলেন ভদ্রমহিলা। “আমি একটা স্কুলে পড়াই। বাংলা। নগরেই স্কুল টা” -“আচ্ছা! সেখান থেকেই ফিরছেন নাকি?” -“না না। স্কুলে শুধু মিড্ডে মিল ই চালু আছে। ডিনার চালু হইনি যে এত রাত্রে ফিরব।“ হাসল অনীশ।
ভদ্রমহিলা বলেই চললেন “বহরমপুর থেকে ফিরছি। সেখানেই বাড়ি আমার” -“এখন ছুটিতে ছিলেন নাকি?” -“হ্যাঁ। বাবা অসুস্থ। একটা নার্সিংহোমে বাবা ভর্তি আছেন। সেখানে ছিলাম। অনেকদিন হল। এখন দুদিন স্কুল করে আবার ছুটি নেবো আর কি”। “ও আচ্ছা! কি হয়েছে ওনার?” -“হার্টের সমস্যা। ভাল্বে ফুটো ধরা পরেছে” কথাটা শুনে একটু যেন মিইয়ে পড়ল অনীশ। হার্টে ফুটো! আর সে সামান্য বাইকের চাকায় ফুটো নিয়ে কিনা… আর ভদ্রমহিলা এরম অবস্থাতেও সমানে রসিকতা করে যাচ্ছে, কথা শুনে তার পরিস্থিতি টের পাওয়া শক্ত। “সরি”-বলল অনীশ -“না না আপনার সরির কি আছে? গড়পড়তা মানুষ আমরা। কম বেশি এরকম ই অবস্থা সবার। ঘাসের মত। রোদে পুড়ে যায়, মানুষ মাড়িয়ে যায়, ছাগল খেয়ে ছেঁটে ফেলে, মনে হয় এই গেল বুঝি, আবার একটু বৃষ্টি পড়লেই দেখবেন কিরম সবুজ হয়ে গেছে সব চাঙ্গা” প্রত্যুত্তরে অনীশ একবার ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাল শুধু। তারপর আবার সামনের দিকে চাইতে লাগল। কাশিপুর ঢুকছে এবার বাসটা। কন্ডাক্টর চিৎকার করছে “কালিতলা মোড়, কালিতলা মোড়”। নামতে হবে। ভদ্রমহিলা ই বললেন “যান। আপনার স্টপ তো এসে গেল” -“হ্যাঁ” -“আপনার নাম কি?” -“অনীশ দত্ত” -“আচ্ছা…আমার নাম…” বাধা দিল অনীশ। “না থাক। বলতে হবে না। আমি জানি” -“কি জানেন?” ভদ্রমহিলার চোখে মুখে বিস্ময়। -“আপনার নাম বনলতা সেন ছাড়া কিছু হতেই পারে না। আচ্ছা আসি।” নেমে গেল অনীশ। বিস্মিত দুটো চোখ তার দিকে চেয়ে রয়েছে তখন ও। বাসটা ছেড়ে যেতেই বৃষ্টি নামল। রেনকোটের প্যাকেট টার দিকে চাইল অনীশ। স্মিত হেসে সেটা বগলদাবা করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে চলল।

Comments