পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, সামনে থামযুক্ত নাটমন্দির, নানারঙের কাঁচের ফানুস আর বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি মনে করিয়ে দেয় সাবেকি ঐতিহ্য আর রাজকীয় জৌলুষের কথা। সময়ের প্রভাবে গ্রাম বাঙলার বহু পূজোকে আধুনিকতা গ্রাস করলেও বীরভূম জেলার সুরুলের সরকার বাড়ির পূজোয় আজও মিশে আছে মাটির গন্ধ, শিকড়ের টান আর আভিজাত্য। তবে শুধু পূজো পার্ব্বন নয় এই পরিবারের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও।
ইতিহাস বলে অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বর্ধমানের নীলপুর অঞ্চল থেকে সুরুলে এসেছিলেন ভরতচন্দ্র সরকার। তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি সরকারের হাত ধরেই এই পরিবারের সমৃদ্ধির সূচনা। অতীতে সুরুল গ্রামটি ছিল এই সম্ভ্রান্ত পরিবারের বানিজ্যকেন্দ্র মাত্র। ভরতচন্দ্রের কোনো পুত্র না থাকায় তিনি তাঁর গুরুদেবের শরণাপন্ন হওয়ায় গুরুর আশীর্বাদে সন্তান লাভ করেন। এতে তাঁর বিশ্বাস জন্মায় এই সুরুল গ্রামটি অত্যন্ত পয়া। সেই থেকেই এই পরিবারের এখানে স্থায়ী বসবাস শুরু।
১৭৮২ খ্রীঃ সুরুলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম রেসিডেন্ট জন চিফ। সুরুলের সরকার পরিবারের প্রাণপুরুষ ভরতচন্দ্র সরকার এই জন চিফের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। এর ফলে তিনি প্রভূত ভূ-সম্পত্তি ও অর্থের অধিকারী হয়ে ওঠেন। এই পরিবারের মূল আয় ছিল নীল চাষ থেকে। এছাড়াও গড়া কাপড় (মোটা থান) এবং চিনির ব্যবসাও ছিল। এক কালে এই পরিবার জিনসের কাপড়ও তৈয়ারি করত যা সেই সময়ে ব্যবহৃত হত জাহাজের পালে। এই সরকার পরিবারেরই শান্তিনিকেতনের জমি কিনেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই পূজোর বয়স সম্ভবত ৩০০ বছর। পূজো শুরু করেন ভরতচন্দ্র সরকার। পরে শ্রীনিবাস সরকারের হাত ধরে।পুজোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। পরবর্তিকালে সম্পত্তির ভাগাভাগির পরে আরও একটি পূজোর সূচনা হয়। সেই পূজোটির বয়সও প্রায় ১০০ বছর। একচালির সাবেকি প্রতিমাকে পরানো হয় ডাকের সাজ। আজও থাকে সোনা রূপোর গহনা। প্রতিমার গায়ের রঙ তপ্তকাঞ্চন। চালচিত্রে আঁকা থাকে শিব ও দুর্গার বিয়ের দৃশ্য। প্রতিমার সাবেকি রূপটি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
সপ্তমীর প্রাতকালে পরিবারের দুটি পূজোর শোভাযাত্রা দর্শনীয়। দিঘিতে স্নান করিয়ে সাবেকি পালকি করে নবপত্রিকা মন্ডপে নিয়ে আসা হয়। ঢাক ঢোল, পাইক বরকন্দাজ সহযোগে শোভাযাত্রা হয়।
এখনও পূজোর কদিন সন্ধ্যায় জ্বালানো হয় সাবেক বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি ও রঙিন ফানুস।
এতে ব্যবহার করা হয় রেড়ির তেলের কুপি। বংশপরম্পরায় বেশ কিছু মানুষ এই কাজে যুক্ত। প্রতিবছর চতুর্থীর দিন তাঁরা সরকার বাড়িতে চলে আসেন। এখনও বংশপরম্পরায় পুরোহিত পূজো করেন এবং হাট শেরান্দি গ্রামের ব্রাহ্মণেরা পূজোয় সহযোগীতা করেন।
পুরোনো প্রথা মেনেই সপ্তমীতে চালকুমড়ো, অষ্টমীতে পাঁঠা, আর নবমীতে আঁখ বলি হয়। অষ্টমীতে বলিদানের পরে সেই বলিদানের খাঁড়া নিয়ে শোভাযাত্রা করে মনসা মন্দিরে গিয়ে সেখানে আরও একটি পাঁঠা বলি দেওয়ার রীতি বহুকালের।
আজও পূজোর কটা দিন সরকার পরিবারের বড় তরফের পূজোয় তিনদিন ব্যাপী যাত্রার আয়োজন করা হয়। আগে ষষ্ঠী থেকে একাদশী পর্যন্ত যাত্রাপালার আযোজন করা হত। এতে ঐতিহাসিক, সামাজিক, ও আধুনিক যাত্রা পালা আযোজিত হত। ছোট তরফের পূজোতে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হয়। সেই আকর্ষনে আজও আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসেন।
পূজোয় অন্নভোগ না হলেও চাল ও ফলের নৈবিদ্য এবং লুচি ভাজা ও অন্যান্য ধরনের মিঠাই ভোগ থাকে। নবমীর দিনে রাজ্য পর্যটন দপ্তরের উদ্যোগে বাসে করে কোলকাতা থেকে বহু দর্শনার্থী এখানে আসেন।
দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে পরিবারের সদস্যেরা নারায়ণ মন্দিরে মিলিত হন। আজও সেখানে শাঁখ বাজিয়ে শঙ্খ চিলের আহ্বান করা হয়। সরকার পরিবারের সদস্যেরা শঙ্খ চিলের দর্শনকে একটি শুভ সঙ্কেত মনে করেন। আগে বাহকরা কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে গেলেও এখন প্রতিমা বিসর্জন হয় ট্রলিতে। তবে অতীতের স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও জ্বালানো হয় মশাল।
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলালেও সাবেকি পূজোর গন্ধ আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি।
তথ্য সংগৃহীত
[uam_ad id=”3726″]