যে আদালত সকালে সাক্ষী নব দম্পতিকে গলা সপ্তমে তুলে একে অপরকে তুলোধনা করতে, বেলা গড়াতে সেই আদালত-ই সাক্ষী থাকল দুই যুগলকে হাতে হাত ধরে খুনসুঁটি করতে করতে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। নেপথ্যে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে বিচারকের দেওয়া এক অভিনব নিদান।
কি সেই নিদান ? ‘বিবাদমান’ স্বামী ও স্ত্রী-কে তিনদিন একসঙ্গে থাকতে হবে হোটেলে! আর হোটেলের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন খোদ বিচারকই! স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী-র করা বধূ নির্যাতনের এক মামলায় শুনানী স্থগিত রেখে সোমবার সিউড়ি আদালতের জেলা ও দায়রা বিচারক পার্থসারথী সেন দিলেন এই নিদান।
গত ২রা মার্চ সিউড়ির ভট্টাচার্য পাড়ার যুবকের সাথে বিয়ে হয়েছে নদীয়ার তেহট্টের যুবতির। কিন্তু অল্প সময়ে সাংসারিক কলহ থাবা বসায় নব দম্পতির জীবনে। বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে গিয়েও অশান্তি মেটাতে পারে নি স্বামী। সমস্যার মীমাংসা চেয়ে জেলা আইনী সহায়তা কেন্দ্রের দ্বারস্থ হন নব বিবাহিতা। গত ৮ই জানুয়ারি সেই আবেদনের শুনানীর দিন হলেও মীমাংসা তো দূর বরং বিবাদের মাত্রা আরও বাড়ে। এরপর ‘অগ্নিশর্মা’ স্ত্রী সটান করে বসেন বধূ নির্যাতনের মামলা। স্বামী, শ্বশুর ও ভাসুরকে অভিযুক্ত করে বধূ থানাকে লিখিতভাবে জানায় যে, বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে সে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের শিকার। এমনকি স্বামী তাকে মারধর করে করে বাড়ি থেকে বের পর্যন্ত করে দিয়েছে। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করেছে। শ্বশুরের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযোগ আনেন, তাকে কু-নজরে দেখা ও কু-প্রস্তাব দেওয়ার। হেনস্থার অভিযোগ আনেন ভাসুরের বিরুদ্ধেও। বধূর অভিযোগ পেয়ে সিউড়ি থানা ভারতীয় দন্ডবিধির ৪৯-এ(বধূ নির্যাতন), ৩০৭(প্রানে মারা চেষ্টা), ৫০৬(হূমকি), ৩৫৪(শ্লীলতাহানি) প্রভৃতি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে। সেই মামলায় অভিযুক্ত বধূর স্বামী তাঁর আইনজীবি মারফত আগাম জামিনের আবেদন জানান। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে এদিন ছিল শুনানী। এই খবর পেয়ে অভিযোগকারি বধূও তাঁর আইনজীবি মারফত আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে জামিনের আপত্তি জানান।
বিচারক দুই পক্ষের আবেদন দেখে ডেকে পাঠান দুজনকেই। এজলাসে হাজির হন দম্পতি। সমস্যার কথা জানতে চাইতেই তেড়েফুঁড়ে ওঠেন দুজনেই। স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে বলেন, দেখুন আমার হাত মুচড়ে দিয়েছে। আমাকে প্রায় মার লাগায়। চরম অত্যাচার করে। আমার প্রাণনাশে চেষ্টা করেছে। শুনে সমান তেতে ওঠে স্বামীও। অভিযোগ তোলে, আমার স্ত্রী ঘরোয়া নয়। ওকে নিয়ে আলাদা ভাড়া বাড়িতে থেকেও সমস্যা মেটে নি। আমার ষাট বছরের বাবার বিরুদ্ধেও নোংরা অভিযোগ তুলেছেন। ও আমাকেই মারধর করে। ওর সঙ্গে থাকলে আমাকে মেরে ফেলবে। স্ত্রী মারধর করে স্বামীকে এই অভিযোগ শুনে বিচারক স্বামীর কাছে জানতে চান তাঁর ওজন কত ? উত্তরে স্বামী বলেন , ‘৭২ কেজি’। স্ত্রীকেও একই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, ’৫৭ কেজি।’ মুচকি হাসেন বিচারক।
শুনানী স্থগিত করে বিচারক দুজনকে পরামর্শ দেন সাতদিনের জন্য ভাড়া বাড়িতে থাকার। আপত্তি তোলেন স্বামী। এরপরই বিচারক মেজাজ চড়িয়ে বলেন স্ত্রী-র সঙ্গে যান না হলে জেলে যেতে হবে। স্বর নীচু হয়ে যায় স্বামীর। মিনমিন করে তোলেন পকেটে টানের কথা। অবশেষে বিচারক তিনদিন হোটেলে থাকার নিদানটি দেন। হোটেলের খরচের ভারও নিজের কাঁধে নিয়ে নেন বিচারক। সেই সঙ্গে সিউড়ি থানার আই সি-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দম্পতি যেন হোটেলে তিনদিন নিভৃতে নিজেদের মত করে কাটাতে পারে এবং বাইরে কেউ যেন তাদের সাথে যোগাযোগ না করতে পারে তা দেখতে। এব্যাপারে সিউড়ি আদালতের সরকারি আইনজীবি রঞ্জিত গাঙ্গুলী জানান, ‘‘মাত্র ক’দিন হল ওঁদের বিয়ে হয়েছে। যে বিষয়গুলি নিয়ে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য সেগুলি খুব একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় নয়। তাই বিচারকের সাথে আলোচনা করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
বিচারকের নিদানেই বদলে যায় স্বামী-স্ত্রী-র ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’। কিছুক্ষন পরেই দেখা যায় দুজনে একে অপরের হাত ধরে আদালত ছাড়ছেন। প্রশ্ন করতেই স্বামী-র উত্তর, ‘‘বিচারকের পরামর্শ মাথা মেতে গ্রহন করেছি।’’ সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী-র জবাব, ‘‘ওঁর উপর আমার সম্পূর্ন ভরসা আছে।’’ এজলাস,কাঠগড়া, সেরেস্তা, উকিল, মক্কেলদের পেছনে ফেলে গুটি পায়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে যান ‘বিবাদমান’ দম্পতি। হোটেল থেকে আবার এজলাসে তারা ফিরবেন আগামী ১৯শে। অপেক্ষায় সকলেই।
সিউড়ি থেকে রণদীপ মিত্র।
-বিজ্ঞাপন-
[uam_ad id=”3726″]