১
–“আচ্ছা বাড়ি ফিরে কথা বলছি। এখন রাখি। স্কুলের টিফিন শেষ। ক্লাস আছে আমার”!
ফোনের লাল বোতাম টা টিপলেন মানিক চক্রবর্তী। বয়স চুয়ান্ন এর কাছাকাছি। রানীনগর হাই স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক তিনি।পাশে হেতমপুর ছোট শহর। সেখানেই বাড়ি তাঁর। সাইকেলে স্কুলে আসেন। স্ত্রী কে একবার ফোন করছিলেন। স্কুলের ঢালা বারান্দার শেষ প্রান্তে, শিশু গাছের পাশটাতে দাড়িয়ে। ভাত খাওয়া, ওষুধ খাওয়া এসব ব্যাপারে একটু জেনে নেওয়া আর কি।
–“মোবাইল ফোন টা এবার পাল্টান মানু দা!”
নিজের সাদাকালো নোকিয়া ফোন টা পকেটস্থ করে ঘুরে দেখলেন মানিক বাবু। পাশের জীর্ণ থাম টাই হেলান দিয়ে মুচকি হাসছে সায়ন। সায়ন রায়। দু বছর হল জয়েন করেছে এই স্কুলে। ভূগোল শিক্ষক হিসেবে। কাছেই সিউরি শহর। সেখানেই তার বাড়ি। ঝকঝকে চেহারা। দাড়ি গোঁপ কামান।ফর্সা গালে দাড়ির গোড়া গুলো সবজে। জিন্স, টি শার্ট আর রানিং সু। ডান হাতে লাল সুতো।“স্মার্ট” বলতে আম মানুষ যা বোঝে সায়ন তাই ই। স্কুলে মানিক বাবুর সাথেই সায়নের বেশি সখ্যতা…অনেকটা বন্ধুর মত।
–“আর বল কেন। বুড়ো হয়ে গেছি। এইটাই মানানসই। কথা বলা হচ্ছে তো”—হেসে উত্তর দিলেন মানিক।
–“কে বলল বুড়ো! আপনার ছেলের বিয়ে হয়নি এখনো। শ্বশুর না হলে কেউ বুড়ো হয় এখন”
–“হা হা”। আবার হাসলেন মানিক।
দুজনে স্টাফরুমের দিকে হাঁটা শুরু করল। আবার সায়ন বলল
–“না সত্যি বলছি মানু দা। ফোন টা পাল্টান এবার। কি একটা হেস্টিংস আমলের ফোন। আপনার ছেলেও চাকরি পেল তো। আপনি না পারলে আপনার ছেলেকেই বলুন আপনাকে একটা অ্যানড্রয়েড ফোন কিনে দিতে”।
হ্যাঁ অ্যানড্রয়েড! এর আগেও দু একদিন বলেছে সায়ন। সেদিন অনেকক্ষণ ধরে মানিক বাবুকে দেখিয়েছিল তার সোনি অ্যানড্রয়েড টা। পুরোটাই ছোঁয়াছুয়ির খেলা। ফোন করা, মেসেজ করা, ছবি তোলা, খবরের কাগজ পড়া। হোয়াটস অ্যাপ নামে কি একটা আছে। তাতে করে একটা ছোঁয়াতে স্কুলের নতুন বিল্ডিংটার একটা ছবি সায়ান পাঠিয়ে দিল তার বন্ধুকে।মানিক বাবুকে বলল “দেখলেন! কত সুবিধা! কতটা আধুনিক”
“হমম”। মেনে নিয়েছেন মানিকবাবু। এমনিতে তাঁর দৌড় বলতে ছিল শুধু গুগলে সার্চ করে বিভিন্ন তথ্য খুজে বের করা। সায়নই তাকে ইন্টারনেট এর বহুমুখিতা দেখিয়েছে!
আর শুধু ফোন, ইন্টারনেট কেন! মানিক বাবুর অনেক কিছুতেই সায়ন মস্করা করে। সেকেলে বলে। মানিক বাবুও অবশ্য আমুদে লোক। হাসাহাসি করেই ব্যাপার গুলো কাটিয়ে দেন!
এই তো বর্ষার শুরুতে! যেদিন তিনি তার বাঁশের হাতলওয়ালা এত্ত বড় ছাতাটা নিয়ে স্কুলে আসলেন। ছাতাটা দেখে সায়ন তো হেসেই খুন। এরকম ছাতা যে এখনো পাওয়া যায় তাই জানত না সে। নিজের ছোট ফোল্ডিং ছাতার পাশে মানুদার ছাতাটা রেখে আকারের বিশালতা টা স্টাফ রুমে উপস্থিত সবাই কে দেখাচ্ছিল সায়ন।
বলল- “বাপরে মানুদা! এই ছাতায় একটা গোটা ক্লাসের না হলেও, একটা সেকশনের ছাত্র তো আরামসে এটে যাবে। হা হা”
নামও দিয়েছে! “সেকশনাল ছাতা”।
মানিক বাবু বলেছেন- “ভালই না! ফ্রীতে একটু সমাজ সেবাটার সুযোগ ও থেকে যাচ্ছে। তোমার ছোট ছাতায় সেটা সম্ভব না”
আবার যেমন জামা কাপড়। দরজি দিয়ে বানান ঢিলে ঢালা জামা আর বড় ফোল্ডয়ালা প্যান্ট পরেন মানিকবাবু। সায়ান বলে “জামা এত লুজ কেন মানুদা”
আরও বলে-“এখন রেডিমেট গারমেন্টসের ফিটিং ভাল। সেগুলো পরুন। জামাটা প্যান্টের মধ্যে গুজে পরতে পারেন না? আর একটা চামড়ার বেল্ট! পারসোনালিটি টা একটু বেশ ফুটে ওঠে তাতে করে। একটু আধুনিক হন মানুদা”
উত্তরে শুধু হাসেন মানিক বাবু!
২
সকাল থেকেই মানিক বাবু লক্ষ্য করছেন সায়ন আজ বেশ অন্যরকম! ক্লাস নিয়ে এসেই স্টাফরুমের টেবিল টার কোনাটায় গিয়ে চুপ করে বসছে। মাঝে মধ্যে সামনের বারান্দায় সিড়িটার কাছে গিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে কাকে যেন ফোন করছে। আজ তার অ্যানড্রয়েড টার এই একটাই ব্যবহার হতে দেখছে মানিক বাবু। কল করা। অন্য ছোঁয়াছুয়ি বন্ধ। দুবার জয় এর সাথে গিয়ে সিগারেটও খেল বাথরুম এর কাছটায় দাড়িয়ে। ক্লাস থেকে দেখেছেন মানিক বাবু।
টিফিনে জিগেস করলেন সায়ন কে।
-“কিছু হয়েছে তোমার? খবর সব ঠিক তো?”
-“না মানু দা”
-“আচ্ছা। বাড়িতে সিরিয়াস কিছু? সেরম হলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও”
-“না না। বাড়ি গেলেই যে সমস্যার সমাধান হবে এরকম না। আমার ভাই টা কে নিয়ে ঝামেলা”
-“রতন ? কি হল তার?শরীর ঠিক আছে তো তার?”
-“তার হয়নি কিছু। তার মাধ্যমে করা হয়েছে। একটা কেলেংকারি”
– “ওহ। ফ্যামিলিগত সেনসিটিভ ইসু? ”
-“হুম”
আর ডিটেল জিগেস করাটা ঠিক হবে না বুঝে মানিক বাবু বললেন-“সে হয়। অনেকের অনেক রকম। ঠিক হয়ে যাবে আপনা হতেই। অত ভেব না”
-“না মানু দা। এত সহজে মেটার নয়। আপনাকে বলি। ব্যাপারটা হল রতন বিয়ে করেছে। বাড়ির অমতে”
-“প্রেম?”
-“হ্যাঁ”
-“হ্যাঁ তাতে অসুবিধা কি? আর রতনও তো চাকরি করে। আচ্ছা বুঝেছি। বউভোজটা ঠিক দিনে দিতে পারছ না? সে কোন ব্যাপার না। যোগারজন্তর করে পরে একদিন দিয়ে দাও জম্পেশ করে। মিটে গেল”
-“ব্যাপার টা হাসির না মানু দা”
-“ওহ”’
-“প্রথম কথা হল মেয়েটা নীচু জাতির। স্বজাতি তো নয় ই। আবার ফ্যামিলিও সেরম! মেয়ের বাবার ছোট একটা মুদির দোকান। পন-টন বাদই দিলাম, অন্তত মেয়ের ফ্যামিলি, জাতি এগুল স্ট্যান্ডার্ড হবে তো”
কথা গুলো সায়ন এর মুখে শুনে একটু অবাক হলেন মানিক বাবু। কিন্তু তর্ক করাটা বা নিজের মত টা অন্যের রুচির উপর চাপিয়ে দেওয়া টা না-পসন্দ তার। তাই শুধু বললেন “তোমার ভাই খুশি হলেই হল। আর কি?”
–‘না না। শুধু সেটা নয়। ওকে নিজের ফ্যামিলির ইমেজ নিয়েও ভাবতে হবে তো, নাকি?”
-“ প্রেমের ব্যাপারে আগে জানতে না?”
-“জেনেছি। সে কয়েকদিন আগেই মাত্র। এমনিতে বাড়িতে এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়না কখনও। হপ্তা দুই আগে রতন মাকে বলেছিল মেয়াটার ব্যাপারে। মা আমায় বলে, পরে বাবাকে। বাবা তো শুনেই আগুন। একদম বরদাস্ত করবে না এই সম্পর্ক, এইটা পরিষ্কার বলেই দিয়েছিল। রতন সেদিন বিশেষ কিছু বলেনি আর। তারপর কাল একদম বিয়ে করেই ঘর ঢুকল। ছি ছি। কেলেংকারির পঞ্চাশ পুরো!”
-“আরে ঠিক আছে। এত আপসেট হয়োনা। মেয়েটা পড়াশুনা করে?”
-‘শুনলাম এমএ পাশ করেছে সবে”
-“আচ্ছা!”
সায়ন বলে চলে “না দেখুন আমার ই এখন বিয়ে হয়নি। সে ছোট আমার থেকে। সবে চাকরিটা পেলি, কদিন দাড়া। কত সম্পর্ক আসত। দেখে শুনে ঠিক মত গুছিয়ে বিয়েটা কি করা যেত না?”
এরই মধ্যে তার অ্যানড্রয়েড আবার বাজতে শুরু করেছে। “ফোনটা ধরি মানু দা” বলে ওপাশটায় সরে গেল সায়ন!
একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে রইলেন মানিক বাবু। সমস্যা টা যে ঠিক কেন সেটাই বুঝে উঠতে পারলেন না।
৩
মাস ছয়েক পরের কথা। এর মাঝে সায়নরা বেশ বড়সড় একটা অনুষ্ঠান ভবনে রতন এর বিয়ের আনুষ্ঠানিক দিক টা সেরে ফেলেছে! জম্পেশ আয়োজন। মানিকবাবু সহ স্কুলের সমস্ত স্টাফের নিমন্ত্রন ছিল। অনেকেই গেছিলেন।
অবশ্য “একটা দাস ফ্যামিলির মেয়ে নিজের ঘরে থাকবে” এটাই সায়ন বা তার বাবা মোটেও স্বচ্ছন্দ অনুভব করেনি। রতন সেটা ভালই বুঝছে। সে সিউড়ির অন্য একটা পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। মোটের উপর সব ঠিকই আছে।
থার্ড পিরিয়ডটাতে কোন ক্লাস নেই আজ মানিক বাবুর। সায়ন, জয় এদেরও ছিল না! সবাই স্টাফ রুমে খোশ গল্পে ব্যস্ত। মানুদার চামড়ার স্যান্ডেল নিয়ে সায়ন আলোচনা শুরু করেছে। বড্ড সেকেলে টাইপ নাকি। শু বা ফিতে ওয়ালা কিটো বেশ মানানসই হত… ইত্যাদি।এরই মধ্যে প্রসঙ্গটা পেড়েই ফেললেন মানিক চক্রবর্তী ।
“সামনের অঘ্রানে ছেলের বিয়ে। বুঝলে। কাল সব ফাইনাল করে আসলাম”
জয় বলল “বাহ। ভাল”
সায়ন বলল “দারুন তো। কোথায় হচ্ছে বিয়ে? মানে মেয়ের বাড়ি কোথায়?”
“সেলিমপুর” বললেন মানিকবাবু!
একটু অবাক হল সায়ন। বলল-“রায়ঘাটার পাশের সেলিম পুর?”
-“হ্যাঁ”
-‘সেখানে হিন্দু আছে? জানতাম না তো”
-“আছে হয়ত পশ্চিম পাড়াটায়। অনেক বড় গ্রাম তো। গঞ্জ টাইপ এর। খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। ঠিক জানিনা”
উত্তর এর ধরনটায় আরও অবাক হল সায়ন। একটা সন্দেহের বুদবুদ ভেসে এল মস্তিস্কে। ঘুরিয়ে জিগেস করলো সায়ন “আচ্ছা। তা মেয়ের নাম কি?”
“রেজিনা সুলতানা”
ব্যস! একটা বলিষ্ঠ উত্তেজনা যেন বয়ে গেল সায়নের মাথা থেকে পা অব্দি। সে যেন নিজের ঢোকটা আর নিজেই গিলতে পারছে না। জয় ও একটু অবাক ।
“কি হল? ওভাবে কি দেখছ?” জিগেস করলেন মানিকবাবু।
“না কিছু না” বলল সায়ন
“আচ্ছা! তো সিউড়ির কোন ক্যাটারার ভাল একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানাও তো আমায়। রতন এর বিয়েতে যেটা তোমরা আনিয়েছিলে সেটা ভালই বেশ। ফোন নাম্বার আছে? হেতমপুরে দুটো আছে। সেগুলো ঠিক জুতসই না”– সায়নের উদ্দেশ্যে বললেন মানিক বাবু।
আর থাকা গেল না। নীচু গলায় জিগেস করেই বসল সায়ন “মানুদা…একটা হিন্দুর মেয়ে পেলেন না বাড়ির বউমা হিসেবে?”
“মানে? হিন্দু না হলে কি প্রবলেম?”
থতমত খেল সায়ন। সেভাবে ঠিক কি প্রবলেম তা বলতে পারল না। শুধু বলল “না মানে…”
মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই মানিক বাবু বললেন “বুঝেছি তুমি কি বলতে চাইছ! আরে হিন্দু মুসলিম উচু নিচু সেসব ছিল শরৎচন্দ্রের আমলে! পড়নি তাঁর উপন্যাস?”
মাথা নাড়াল সায়ন। ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ কিছুই বোঝা গেল না! একদম চুপ সে।
মানিক বাবু বলে চললেন –“তবে? সেই আমলে পড়ে থাকলে হবে? এখনকার দিনে হিন্দু মুসলিম তো অ্যাডমিশন ফর্মে একটা ‘টিক’ মার্ক। তোমার ওই অ্যানড্রয়েড হলে একটা ছোট চৌক ঘরে একটা ছোঁয়া মাত্র। তার সাথে বিয়ের কি?”
–“না মানে তবুও…”
আবার তাকে শেষ করতে দিলেন না মানিক বাবু
-“আর এতে আমার হাত টা কোথায়? ছেলের পছন্দ।তার প্রেমিকা। আমি কে তাতে হাড্ডি হওয়ার? হা হা! মেয়ের বাড়ি থেকেও খুব খুশি। অনিমা একটু আপত্তি করছিল। পরে সুমন এর সাথে কথা বলে বলছে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’।সুমন আর তার মায়ের যখন অসুবিধা নেই, তখন আমার কি!আর আমার সাত কুলে তো সেরকম কেউ নেই, তাই ওই দুজনের মত ই ‘সর্বসম্মতি’ আর কি। হা হা”
পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজল। উঠলেন মানিক বাবু। “আমার এখন টেনের ক্লাস আছে। যাই। সায়ন তুমি তাহলে ক্যাটারার টা দেখ একটু”
চক আর ডাস্টার নিয়ে আসতে আসতে বেড়িয়ে গেলেন। তাঁর পুরনো স্যান্ডেল এর আওয়াজও দামী লেদার শু এর মত মশমশে শোনাল সায়ন এর কানে!
-বাপ্পাদিত্য