কৌশিকী অমাবস্যা, অন্য সব অমাবস্যার থেকে একটু আলাদা। কারণ তন্ত্রমতে ও শাস্ত্রমতে ভাদ্র মাসের এই তিথিটি একটু বিশেষ কারণ অনেক কঠিন ও গুহ্য সাধনা এই দিনে করলে আশাতীত ফল মেলে, সাধক কুন্ডলিনী চক্রকে জয় করে,বৌদ্ধ ও হিন্দুতন্ত্রে এই দিনের এক বিশেষ ‘মহাত্ব আছে, তন্ত্রমতে এই রাতকে তারারাত্রি বলা হয় ও এক বিশেষ মুহুর্তে স্বর্গ ও নরক দুই এর দুয়ার মুহুর্তের জন্য উম্মুক্ত হয় ও সাধক নিজের ইচ্ছা মতো ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি নিজের সাধনার মধ্যে আত্মস্থ করে, ও সিদ্ধি লাভ করে। চন্ডিতে বর্ণিত মহাসরস্বতী দেবীর কাহিনীতে বলা আছে, পুরাকালে একবার সুম্ভ ও নিসুম্ভ কঠিন সাধনা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে চতুরানন তাদের বর প্রদান করেন কোনো পুরুষ তাদের বধ করতে পারবেনা শুধু কোনো অ-যোনি সম্ভূত নারী তাদের বধ করতে পারবে অর্থাৎ এমন এক নারী যে কোনো মাতৃগর্ভ থেকে উৎপন্ন হয়নি তার হাতেই এই দুই অসুর ভাই এর মৃত্যু হবে, আর পৃথিবীতে এমন নারী কোথায়? এমনকি আদ্যাশক্তি মহামায়া মানকা রানীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন তাই তিনিও ওদের নাশ করতে পারবেন না,তবে কি উপায়? পূর্বজন্মে পার্বতী যখন সতী রূপে দক্ষযজ্ঞস্থলে আত্মাহুতি দেন তার কারণে এই জন্মে ওনার গাত্র বর্ণ কালো মাঘের মতো তাই ভোলানাথ আদর করে তাকে কালিকা ডাকতেন। একদিন দানব ভাইদের দ্বারা পীড়িত দেবতারা যখন ক্লান্ত কৈলাশে আশ্রয় নিলেন, শিব সব দেবতাদের সামনেই পার্বতীকে বললেন “কালিকা তুমি ওদের উদ্ধার করো ” সবার সামনে কালী বলে ডাকাতে পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ,অপমানিত ও ক্রোধিত মনে মানস সরোবের ধারে কঠিন তপস্যা করলেন ও তপস্যান্তে শীতল মানস সরোবর এর জলে স্নান করে নিজের দেহের সব কালো কোশিকা(melanin) পরিত্যাগ করলেন ও পূর্নিমার চাদের মতো গাত্রবর্ণ ধারণ করলেন ও ওই কালো কোশিকাগুলি থেকে এক অপূর্ব সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ দেবীর সৃষ্টি হয় ইনি দেবী কৌশিকী। সেই তিথি যেদিন এই দেবীর উৎপত্তি হয় ও সুম্ভ ও নিসুম্ভকে বধ করেন। তাই এই অমাবস্যার নাম কৌশিকী অমাবস্যা। আবার এই দিনে দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী তারা আজ মর্তধামে আবির্ভূত হন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম জেলায় অবস্থিত তারাপীঠে এই উপলক্ষ্যে বিশাল উৎসব হয়। তারা দেবীকে বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্গত বজ্রযানে নীলসরস্বতী ও বলাহয়। লোকে বিশ্বাস করে এই তিথিতে ভাত খেতে নেই।
এই কৌশিকী অমাবশ্যায় তারাপীঠের মন্দিরে চলে নানা ধরনের পূজা ও সাধনা। তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মন্দির নগরী। এই শহর তান্ত্রিকদেবী তারার মন্দির ও মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুদের বিশ্বাসে, এই মন্দির ও শ্মশান একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এই মন্দির শাক্তধর্মের পবিত্র একান্ন সতীপীঠের অন্যতম। এই স্থানটির নামও সেখানকার ঐতিহ্যবাহী তারা আরাধনার সঙ্গে যুক্ত।
তারাপীঠ সেখানকার ‘পাগলা সন্ন্যাসী’ বামাক্ষ্যাপার জন্যও প্রসিদ্ধ। বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে পূজা করতেন এবং মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রে কৈলাসপতি বাবা নামে এক তান্ত্রিকের কাছে তন্ত্রসাধনা করতেন। বামাক্ষ্যাপা তারা দেবীর পূজাতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মন্দিরের অদূরেই তার আশ্রম অবস্থিত।
তারাপীঠ মন্দিরের উৎস ও তীর্থমাহাত্ম্য সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তি লোকমুখে প্রচারিত হয়ে থাকে। এগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিংবদন্তি হলো- ‘শক্তিপীঠ’ ধারণাটির সঙ্গে যুক্ত পৌরাণিক কাহিনিটি। শিবের স্ত্রী সতী তার পিতা দক্ষের ‘শিবহীন’ যজ্ঞ সম্পাদনার ঘটনায় অপমানিত বোধ করেন। স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তিনি যজ্ঞস্থলেই আত্মাহুতি দেন। এই ঘটনায় শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করেন। তখন বিষ্ণু শিবের ক্রোধ শান্ত করতে সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন।
সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে পতিত হয়। এই সকল স্থান ‘শক্তিপীঠ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গেও এই রকম একাধিক শক্তিপীঠ অবস্থিত। এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পীঠ হলো কালীঘাট ও তারাপীঠ। সতীর তৃতীয় নয়ন বা নয়নতারা তারাপুর বা তারাপীঠ গ্রামে পড়ে এবং প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। ঋষি বশিষ্ঠ প্রথম এই রূপটি দেখতে পান এবং সতীকে তারা রূপে পূজা করেন।
তারাপীঠ অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে- সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত হলাহল বিষ পান করার পর বিষের জ্বালায় শিবের কণ্ঠ জ্বলতে শুরু করে। এই সময় তারাদেবী শিবকে আপন স্তন্য পান করিয়ে সেই জ্বালা নিবারণ করেন। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, বশিষ্ঠ তারাপীঠ নামে প্রসিদ্ধ এই তীর্থে দেবী সতীর পূজা শুরু করেন। পীঠস্থানগুলির মধ্যে তারাপীঠ একটি ‘সিদ্ধপীঠ’। অর্থাৎ এখানে সাধনা করলে সাধক জ্ঞান, আনন্দ ও সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।
লোকমুখে প্রচারিত একটি কিংবদন্তী অনুসারে, বশিষ্ঠ এখানে তারাদেবীর তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অসফল হন। তখন তিনি তিব্বতে গিয়ে বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বুদ্ধ তাকে বামমার্গে মদ্যমাংসাদি পঞ্চমকারসহ তারাদেবীর পূজা করতে বলেন। এই সময় বুদ্ধ ধ্যানযোগে জানতে পারেন, মন্দিরে তারামূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজার করার আদর্শ স্থান হলো তারাপীঠ। বুদ্ধের উপদেশক্রমে বশিষ্ঠ তারাপীঠে গিয়ে ৩ লক্ষ বার তারা মন্ত্র যপ করেন। তারাদেবী প্রীত হয়ে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হন। বশিষ্ঠ দেবীকে অনুরোধ করেন বুদ্ধ যে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারাদেবীকে ধ্যানে দেখেছিলেন, দেবী যেন সেই রূপেই তাকে দর্শন দেন। দেবী সেই রূপেই বশিষ্ঠকে দর্শন দেন এবং এই রূপটি প্রস্তরীভূত হয়। সেই থেকে তারাপীঠ মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা মূর্তিতে দেবী তারা পূজিত হয়ে আসছেন।
তারাপীঠ কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে রাতভর বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। শোনা যায়, কৌশিকী অমাবস্যার দিন তারাপীঠ মহাশ্মশানের শ্বেতশিমূল বৃক্ষের তলায় সাধক বামাক্ষ্যাপা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ফলে ওই দিন মা তারার পূজা দিলে এবং দ্বারকা নদীতে স্নান করলে পুণ্যলাভ হয়।
তথ্যঃ সৃতমা পাল