একসময় জেলার রাজধানী ছিল রাজনগর। ইতিহাসের রয়েছে, বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে নিজের নাম অনুসারে লাক্ষ্ণুর বা লক্ষ্ণৌর নামে একটি নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে সেটি নাগর বা নগর নামে বেশি জনপ্রিয় হয়। সেই নগর-ই ছিল বীরভূমের রাজধানী। জনশ্রুতিও সেই ঐতিহাসিক তথ্যকে সমর্থন করে। কয়েক শতক ধরে যে জনপদ বীরভূমের রাজধানী ছিল, যে ভূখণ্ডে কয়েকশো বছর ধরে কখনও হিন্দুরাজা কখনও বা মুসলিম রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছে, একদা গৌরবময় সেই শহরটাই বর্তমানে জেলার একটি পিছিয়ে পড়া ব্লকের তকমা সাঁটা গঞ্জ শহর। অথচ জেলার পর্যটন মানচিত্রে একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণস্থল হিসাবে স্বচ্ছন্দে জায়গা পেতে পারে রাজনগর।
রাজনগর, গঞ্জ শহরের ইতিহাস সুদীর্ঘ কালের।
জনশ্রুতি, এলাকায় ছড়িয়ে থাকা প্রামাণ্য একাধিক ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং বীরভূমের একদা রাজধানী সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের মতামত অনেকটা এই রকম। বহু শতাব্দী আগে থেকেই উত্তর ভারত থেকে তৎকালীন বাংলায় বা পূর্বভারতের প্রবেশপথের একেবারে সামনে থাকা রাজনগরের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। যে জন্য অসমান ও জঙ্গলাকীর্ণ ভূখণ্ড রাজনগরের উপর তাই অনেককাল আগে থেকেই রাজা, বাদশাদের নজর ছিল। সেই প্রেক্ষিতেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রাজনগরে মুসলিম শাসকদের আধিপত্যের সূচনা হয়।
তার আগে পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রাজনগর হিন্দু রাজাদের দখলে ছিল। বীরভূমের ওই রাজধানীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন বীররাজা নামে এক হিন্দু রাজা। সেই সময় দুই পাঠান সেনা আসাদুল্লা খান ও জোনেদ খান বীররাজার কাছে আসেন। নিজেদের পরাক্রমের পরিচয় দিয়ে রাজার বিশ্বাসভাজন হন। ক্রমে রাজার বিশ্বস্ত সচিব বা সেনাপতি হন দুই পাঠান।
কথিত আছে, রানীর সহযোগিতায় জোনেদ খানই বীররাজাকে হত্যা করেন। সেইসময় মৃত্যু হয়েছিল আসাদুল্লা খানেরও। রানি ও জোনেদের মৃত্যুর পর রাজনগরের সিংহাসনে বসেন জোনেদ- পুত্র বাহাদুর খান। সেই শুরু, তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাজনগর শাসিত হয়েছে, বংশ পরম্পরায়। প্রজা বৎসল এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনগরের রাজাদের বহু গল্প এখনও চর্চায়। উল্লেখ্য, বাহাদুর খানের উত্তরপূরুষ আসাদ-উল্লা খানের সঙ্গে তৎকালীন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। আসাদ-উল্লার ছেলে বদি ওজ্জমান খান এবং নাতি আহম্মদ ওজ্জমান এবং আলিনকি খানদের (যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন১৭১৮-১৭৫২) সঙ্গেও মুর্শিদাবাদের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল।
রাজনগরের মুসলিম শাসনকালের সেরা সময় সেটা। আসাদ-ওজ্জমান বা আসাদজামা খানের (যিনি আলিনকির ভাই ছিলেন) শাসনকাল থেকেই আবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তার অন্যতম কারণ, ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয় এবং ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ। এতদিন পর্যন্ত রাজনগরের রাজাদের সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যে নমনীয়তা দেখাতেন নবাব, ব্রিটিশ এবং তাঁদের মনোনীত নবাব মীরকাশিম সেটা দেখাননি। রাজস্ব আদায়ের জোড়া চাপের জন্য শুরু হয় কোন্দল। এরপরই সিউড়ির কাছে কড়িধ্যায় এবং হেতমপুরে রাজনগরের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ হয় ব্রিটিশ ও নবাবের যৌথ বাহিনীর। চূড়ান্ত পরাজয় হয় রাজনগরের রাজার।
আনুমানিক ১২০৫ খ্রীষ্টাব্দে সম্ভবত বক্তিয়ার খিলজী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বীরভূম। সিউড়ির কাছে বীরসিংহ পুরে বীরসিংহ নামে এক রাজা (যিনি সেন বংশের সময়ই) বীরভূমের রাজা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন। রাজনগর তাঁরই অধীনে ছিল হয়তো। বীর রাজাকে পরাজিত করে সেই সময় রাজনগরের দায়িত্ব দেওয়া বিশ্বস্ত অনুচর মহম্মদ সিরানকে। কিন্তু সেই সময় মুসলিম শাসকেরা তাঁদের শাসনকাল দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। রাজনগর ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আক্রান্ত হয়েছিল ওড়িষ্যার জাজপুরের এক রাজার দ্বারা। এমন মনে করা হয়, এর পরবর্তী কালে বীর রাজার বংশ ধরেরাই রাজনগর শাসন করেছেন।
সুদীর্ঘ সময় রাজনগর বীরভূমের রাজধানী হিসাবে শাসিত হয়েছে, পরতে পরতে তাই ইতিহাস জড়িয়ে। প্রাচীন রাজপ্রাসাদ কালের গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু কালীদহ নামে পুকুরের দক্ষিণদিকে রাজপ্রাসাদের কিছু ধ্বংসাবাশেষ দেখতে পাওয়া যায়। কালীদহের মধ্যে একখণ্ড দ্বীপের মত জায়গায় আরাম নিবাস কোথাও ওড়িষ্যা স্থাপত্যশৈলির নিদর্শন। বর্তমানে যদিও হাওয়া মহলের জীর্ণদশা। প্রাচীনতম নিদর্শ গুলির মধ্যে মতিচূড় মসজিদ অন্যতম। ইটের তৈরি মসজিদের গায়ে কারুকার্যে ইসলামি অলঙ্কার ও হিন্দু রীতির রূপসজ্জার সংমিশ্রণ লক্ষ্যনীয়। মুসলিম শাসনের সাক্ষ্য বহনকারী ইমামবাড়া, অন্দরমহলে থাকা রাজপরিবারের মহিলাদের জন্য স্নানাগার, বারুদখানা রাজপরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এখানেই ভ্রমণক্ষেত্রের দাবি উঠেছে।
সৌজন্যে:-আনন্দবাজার পত্রিকা(রাজনগর, ১৯ মে, ২০১৫)
Image :- Antu Das