Home » জেলার ইতিহাস » সুপুরের ইতিকথা

সুপুরের ইতিকথা

বোলপুর শহরের ৩ কি.মি দক্ষিণে অজয় নদের তীরে অবস্হিত সুপুর এক অতি সমৃদ্ধ ও ঐতিহাসিক গ্রাম। সুপুরে অবস্থিত বিভিন্ন পুরনো বাড়ি থেকে উঁকি মারা দেওয়ালের ইট আর মন্দির গাত্রে থাকা বট, অশথের শিকড় আজও বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী আঁকড়ে ধরে আছে৷
বোলপুর শহর গড়ে ওঠার বহু আগেই সুপুর ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য কেন্দ্র৷ অজয় নদীপথে হাজারিবাগ, সুরাট, চন্দ্রকেতুগড়, তিব্বত, অসম সহ নানা জায়গা থেকে আসা পন্যসামগ্রীর ব্যবসা-বাণিজ্য চলত সুপুরে৷ আজ থেকে আড়াই-তিনশো বছর আগের কথা, ব্যবসার জন্য বাংলার উপকূলে তখন আসতে শুরু করেছে পোর্তুগিজরা৷ সেই সময় বাংলায় নুনের ব্যবসা করতে একদল ব্যবসায়ী আসে গুজরাট থেকে৷ তারাই আজ গন্ধবণিক চন্দ্র হিসেবে এই বাংলায় পরিচিত৷ কাটোয়ার গঙ্গার ধারে লবণগোলাই ছিল এদের ব্যবসার কেন্দ্র৷ এক সময় জমি জায়গা কিনে শ্রীবাটি গ্রামে স্থায়ী হয়েছিল তারা৷ এখান থেকে সুপুর বন্দরে লবণ আসত৷ সুপুরের অজয় তীরে দুটি ঘাট ছিল৷ বর্তমান সুপুর দক্ষিণ পাড়ার পশ্চাতে ছিল ‘মাঠতলার’ ঘাট, আর একটু পশ্চিমেই ছিল ‘নুন ভাঙা ঘাট’, এখানে ভিজে নুন শুকিয়ে গুঁড়ো করা হত। যে স্থানে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসতেন, সেটি বর্তমানে হাটরসুলগঞ্জ নামে পরিচিত৷ ১৮৫০ সালে খানা থেকে সাঁইথিয়া গামী রেলপথ নির্মানের জন্য অজয় নদের উপর রেল ব্রীজ (বত্রিশ ফোঁকর) তৈরি হল৷ এর রূপকার ছিলেন রাইপুরের জমিদার পরিবারের নীলকন্ঠ সিংহের পুত্র রুদ্রপ্রসন্ন সিংহ এবং স্টেম্বার সাহেব৷ তাই সুপুর বন্দরের গুরূত্ব কমতে থাকে ধীরে ধীরে৷ রসুলগঞ্জের হাট উঠে গিয়ে বসল বর্তমান বোলপুর হাটতলায়৷ বোলপুরের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রাইপুর, সুপুর, সর্পলেহনা, রূপপুর, বেড়গ্রাম, দেবগ্রাম, গয়েশপুর সহ নানা গ্রামগুলি থেকে মানুষজনের ঢল নামে বোলপুরে৷ অজয়ের তীরের ইটন্ডা, সুপুর, ইলামবাজার বন্দরগুলি ফলস্বরূপ বিলীন হতে থাকে৷                         
অতীতে সুপুরের নাম ছিল ‘স্বপুর’/ ‘সুবাহুপুর’৷ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার পূর্বে লাড় দেশে (বর্তমান বাংলার রাঢ় অঞ্চল) রাজত্ব করতেন রাজা সুবাহু সিংহ৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত জনপদ সুবাহুপুরই হল আজকের সুপুর৷ অতীতে সুপুর ছিল একটি রাজ্য৷ রাজা সুবাহুর পরবর্তী এক বংশধর ছিলেন রাজা সুরথ৷ কিংবদন্তি ঘটনা অনুযায়ী পৌরানিক রাজা সুরথ রাজ্যহারা হয়ে এখানেই আশ্রয় নেন। মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী তিনিই নাকি নতুন করে প্রথম বসন্তকালীন দুর্গা পুজা শুরু করেন৷ হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরে পেতে তিনি ভগবতী দেবী শিবিক্ষার (গ্রামদেবী) উপাসনার জন্য লক্ষ বলি দেন বলে জনশ্রুতি আছে৷ এই বলি সুপুরের শিবিক্ষা মন্দির (বাঘালা পুকুরের পার্শ্ববর্তী মন্দিরটি) থেকে শুরু করে রজতপুরের মহামায়া মন্দির হয়ে বোলপুরের ডাঙ্গালি কালিতলা পর্যন্ত  হয়েছিল৷ এরপরই  ডাঙ্গালি  কালিতলা  ও  তার  পার্শ্ববর্তী অঞ্চল  বলিপুর  নামে  খ্যাত হয়। এই  বলিপুরই কালক্রমে হয়ে ওঠে   আজকের বোলপুর।
উপরিউক্ত শিবিক্ষা মন্দিরের পশ্চিম কোণেই  রয়েছে বাঘালা (বাঁধা ঘাট) পুকুর৷ পরবর্তী আমলে তৈরি পুকুরটির পূর্ব পাড়ে বাঁধানো সিঁড়ির সম্মুখেই ছিল দুটি বাঘের মূর্তি, কয়েকবছর আগেও যা লক্ষ্য করা যেত, কিন্তু কালের কপোঘাতে আজ তা বিলুপ হয়ে পড়েছে৷ এই বাঘ মূর্তি থেকেই পুকুরের নাম হয় বাঘওয়ালা পুকুর, এখন যা শুধুমাত্র বাঘালায় রূপান্তরিত হয়েছে৷
রাজা সুরথের নামধারী সুরথেশ্বর মন্দির (শিবতলা) বোলপুর-ইলামবাজার সড়কের পাশেই অবস্হিত৷  সুরথেশ্বর মন্দির একসময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল৷ প্রায় একশো বছর আগে গজপতিনাগা নামে এক শৈব সাধু  মন্দিরে এসে এই মন্দিরের আংশিক সংস্কার সাধন করেন৷ ১৩৩৯  বঙ্গাব্দে রাইপুরের জমিদার বংশজ প্রমথনাথ সিংহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তার অর্ধাঙ্গিনী শ্রীমতি সুভাষিনী দাসীর সহায়তায়  সুরথেশ্বর  মন্দির নতুন করে তৈরি হয়৷
    সুপুরের প্রধান আকর্ষন এখানকার প্রসিদ্ধ জোড়া শিব মন্দির,  যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭১৭ সালে৷ এটি ছিল একটি পারিবারিক মন্দির যা তৎকালীন সময়ে স্থানীয় কোনো এক ময়রা পরিবার কর্তৃক তৈরি হয়েছিল৷ বর্তমানে  মন্দিরটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত রয়েছে৷
এছাড়াও সুপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটি  মন্দির।
এই সুপুরের সাথেই জড়িয়ে আছে আর এক বিখ্যাত মানুষ আনন্দচাঁদ গোস্বামী৷ তিনি ছিলেন শ্যামসুন্দর জিউ (ভগবান শ্রী কৃষ্ণ)-এর পরম উপাসক৷ এখানে ছিল তাঁর আশ্রম, যাকে তখনকার দিনে বৃন্দাবনের সমতুল্য হিসেবে সমাদৃত করা হত। আনন্দচাঁদ গোস্বামী নাকি ছিলেন  একাধারে ব্রহ্মজ্ঞানী, বাক্যসিদ্ধি ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী৷ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা, আজও সুপুরে কান পাতলেই শোনা যায়। খুসুটিকুড়ির পীরতুল্য সিদ্ধপুরুষ হজরত হোসেন একবার আনন্দচাঁদের শক্তি পরীক্ষার জন্য বাঘের পিঠে চড়ে দেখা করতে আসছিলেন বাঘের পিঠে চড়ে। সঙ্গে সোনার থালায় সুন্দর করে ঢেকে উপঢৌকন এনেছিলেন হিন্দুর নিষিদ্ধ মাংস। আনন্দচাঁদ তখন ভাঙা পাঁচিলের উপর বসে কাজকর্ম দেখছিলেন। হজরত সুপুরের প্রান্তে উপস্থিত হলেই, তিনি পাঁচিলকে বললেন চল… পাঁচিল চলতে লাগল, এসে হাজির হল গ্রামে ঢোকবার পথে। হজরত তো এই দৃশ্য দেখে অবাক। তাঁর আর সাহস হচ্ছিল না, ওই উপঢৌকন আনন্দচাঁদকে দেবার। আনন্দচাঁদ কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, ওহে বন্ধু আমার জন্য কি এনেছো, দেখাও এবার। হজরত থালার কাপড় সরাতেই হতচকিত হয়ে গেলেন…থালায় মাংস কই! এতো সদ্য ফোটা লাল জবা ফুল (তারাশঙ্করের লেখায় পদ্ম ফুল)। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত সাল পর্যন্ত বাংলায়                                                                                        বিশেষ করে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভয়ানক বর্গী আক্রমণ ঘটে। বর্গীরা ছিল জাতিতে মারাঠা, সংঘবদ্ধ ও লুঠতরাজপ্রিয় অশ্বারোহীর দল। বাংলায় এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পন্ডিত৷ ১৭৪৫ সালে বীরভূমে বর্গী আক্রমণকালীন অবস্থায় আনন্দচাঁদ গোস্বামী একদা এই আক্রমন প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। বর্গীদের আক্রমনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আনন্দচাঁদের নেতৃত্বে স্থানীয়রা সুপুরের পুকুরগুলিতে খাল কেটে গড় তৈরি করে, সকলে অস্ত্রেসজ্জিত হয়ে লুকিয়ে থাকে৷বর্গীরা আক্রমণ করতে এলে  তারা আকস্মিক পাল্টা তীব্র আক্রমণ শুরু করে৷ স্বভাবতই বর্গীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়৷
সুপুরে পরবর্তীকালে জমিদারত্ব দেখা যায়। সুপুরের জমিদার তখন গুপ্তিপাড়া হতে আগত গোপাল মজুমদার৷ সুরথের স্মৃতিতে হাটসেরান্দীর গোমস্তা চাটুজ্জেরা বাসন্তীপুজার প্রচলন করলেন পুরনো হাটতলায়৷ জমিদারদের কিছু গৃহ নতুন করে মেরামত করে উত্তরসূরীরা বাসযোগ্য করে তুলেছেন৷ তবে সুপুরের জমিদারদের ক্ষমতায় ততটা আধিক্য ছিল না।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                            
তথ্যসূত্র :    ১) রাধা (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)
২) পর্যটকের বীরভূম – আদিত্য মুখোপাধ্যায়
৩) বীরভূম দর্পণ – বিজয় কুমার দাস
৪) সুপুর-রজতপুরের প্রত্ন গুরুত্ব – সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় (রজতপুর ইন্দ্রনারায়ণ বিদ্যাপীঠ থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ)

বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন : ১) সুবল চন্দ্র মন্ডল (নূরপুর)
২)অম্বিকাচরণ দে (সুপুর)
৩) রঞ্জিৎ ব্যানার্জী (সুপুর)
ছবি ও তথ্যঃ সুকেশ মন্ডল

-বিজ্ঞাপন-
[uam_ad id=”3726″]

Comments